প্রাক-মোগল বাংলার চিত্রকলা

মমতাজুর রহমান তরফদার

ইতিহাসবিদ ও লেখক

পূর্বভারতীয় রীতির অনুসৃতি

পাল আমলের কতকগুলি চিত্রে অজন্তার বর্তনাব্যঞ্জনাময় ক্লাসিক্যাল রীতি অবক্ষয়িত হয়ে মধ্যযুগীয় রেখানির্ভর অঙ্কন-পদ্ধতির সৃষ্টি করেছে। কতকগুলি চিত্রে আবার এই দুই বৈশিষ্ট্যের সম্মিলন বা সহাবস্থান দৃষ্টিগোচর। ভিন্ন কতকগুলি চিত্রকর্মে রেখানির্ভর বৈশিষ্ট্য পুরোপুরি প্রকাশ পেয়েছে। সে যুগের চিত্রগুলি ক্রমবিবর্তনের তীক্ষ্ণ বৈশিষ্ট্যে চিহ্নিত নয়। শিল্পকর্মগুলি যেন ক্ল‍্যাসিক্যাল ও মধ্যযুগীয় রীতির অবস্থান্তরের পর্যায়ে কিছু দোলায়মানতা নিয়ে বিদ্যমান।

এই পূর্ব-ভারতীয় চিত্ররীতি মুসলমান আমলেও পুরোপুরি লোপ পায়নি। এ-কথার প্রমাণ পাওয়া যাচ্ছে তের শতক থেকে সতের শতকের মধ্যকার কতকগুলি পুঁথির চিত্রকর্ম থেকে। সতের শতকের পুথিখানা ভাগবত পুরাণের দশম স্কন্ধের অনুলিপি। অবশিষ্ট পুঁথিগুলি তান্ত্রিক বৌদ্ধ ধর্মের সঙ্গে সম্পর্কিত। টোকিও বিশ্ববিদ্যালয়ে সংরক্ষিত একখানি পুঁথিতে অঙ্কিত চিত্রগুলিতে অমোঘ-সিদ্ধি লোকনাথ মঞ্জুঘোষ মৈত্রেয় ও আরো কয়েকজন বৌদ্ধ তান্ত্রিক দেবতার শরীর অঙ্কনে অবিন্যস্ত রেখার ও প্রায় সমমাত্রিক রঙের ব্যবহার বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার মতো। এই শিল্পকর্মে বর্তনার আভাস প্রায় বিলীয়মান। কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটির গ্রন্থাগারে রক্ষিত পঞ্চরক্ষার একটি পান্ডুলিপি পরমেশ্বর পরম ভট্টারক পরমরাজাধিরাজ শ্রীমদ্ গৌড়েশ্বর মধুসেনদেবের রাজত্বকালে ১২১১ শকাব্দে বা ১২৮৯ খ্রিস্টাব্দে চিত্রিত। অঙ্কিত চিত্রগুলিতে একমাত্রিক রঙের হালকা প্রলেপে বর্তনার লক্ষণ নেই; রেখার কুঞ্চিত ও খন্ডিত ব্যবহারের দরুন দেহসীমার প্রবাহ ব্যাহত। রঙ ও রেখার এই ধরনের ত্রুটিপূর্ণ ব্যবহারের জন্য অঙ্কিত দেহের আকারে ও ভঙ্গিতে সাবলীলতা ও মসৃণতা নেই। ১৫০৩ বিক্রমাব্দে বা ১৪৪৬ খ্রিস্টাব্দে লিখিত কালচক্রতন্ত্রের একখানি পুথির দুটি পাটার উভয় দিকে আঁকা ছবিগুলিতে মধ্যযুগীয় শিল্পরীতির বৈশিষ্ট্যগুলি দৃষ্টিগোচর। নীলায়িত প্রবহমান রেখার বদলে চিত্রগুলিতে আছে কুঞ্চিত ও বিচ্ছিন্ন রেখা। এইজন্য চিত্রগুলিতে দেহের ভঙ্গি ও গড়ন বিচ্ছিন্ন ও ব্যাহত। রঙের ব্যঞ্জনাময় বর্তনা ছবিগুলিতে নেই। ঠিকরে পড়া চোখও এই শিল্পকর্মে প্রকট। ১৫১২ বিক্রমাব্দে বা ১৪৫৫ খ্রিস্টাব্দে আঁকা কারভব্যুহের চিত্রগুলিতেও রেখা কুঞ্চিত। পূর্বোক্ত কালচক্রযানের চিত্রে অঙ্কিত রেখার তুলনায় অবশ্য এই রেখাগুলি কিছুটা লীলায়িত ও প্রবহমান। তবে চিত্রগুলিতে রঙের বিন্যাসে ব্যঞ্জনা অনুপস্থিত; দেহসীমার বাইরে ঠিকরে-পড়া চোখও এই চিত্রগুলির অন্যতম বৈশিষ্ট্য। ১৪০১ শকাব্দে বা ১৪৭৯ খ্রিস্টাব্দে অনুলিখিত, কলকাতার এশিয়াটিক সোসাইটিতে সংরক্ষিত হরিবংশের পাটায় আঁকা চিত্রেও এই বৈশিষ্ট্যগুলি লক্ষ্য করা যায়। মোগল আমলের বাংলায় শিল্পকর্মের ঐতিহাসিক পটভূমি অনেকটা পালটে যায়। তখনো উপরে উল্লিখিত শৈল্পিক ঐতিহ্য মৃদুভাবে প্রবহমান ছিল। ১৬১১ শকাব্দে বা ১৬৮৯ খ্রিস্টাব্দে আঁকা ভাগবত পুরাণের দশম স্কন্ধের চিত্রগুলিতেও রেখাবিন্যাসে আছে বর্তনার আভাস। উপরোক্ত তিনটি পুঁথির চিত্রে বিদ্যমান ক্লাসিক্যাল রীতির এই বৈশিষ্ট্যের মধ্যে সরসী কুমার সরস্বতী উজ্জীবনের সক্ষণ খুঁজেপেয়েছেন।’ পূর্ব-ভারতীয় চিত্রকলার অন্তিম নিঃশ্বাসের দিনগুলিতে তৈরী এই ধরনের বিচ্ছিন্ন শিল্পকর্ম নান্দনিক শিল্পকলার ইতিহাসে তাৎপর্যপূর্ণ।

পূর্ব-ভারতীয় রীতির চিত্রকলার উদ্ভব ও অবক্ষয়ের সঙ্গে এই অঞ্চলের আর্থিক অবস্থা ও বৌদ্ধ ধর্মের ইতিহাস অবিচ্ছিন্নভাবে সম্পর্কিত। বৌদ্ধ ধর্ম ও শিল্প ছিল গোষ্ঠীকেন্দ্রিক; আর গোষ্ঠীগুলির ক্রিয়াকর্ম সীমিত ছিল বিহার-সঙ্ঘারামের মধ্যে। বৃহত্তর সমাজ-জীবনের সঙ্গে তারা ছিল প্রায় সম্পর্কহীন। প্রাক-মুসলিম আমলে দীর্ঘ দিন ধরে বৌদ্ধ ধর্ম ও বৌদ্ধ শিল্পকলা রাজশক্তির পোষকতা ও বণিক সমাজের সাহায্য-সমর্থন পেয়ে আসছিল। যখন মুসলমান আক্রমণকারীদের আঘাতে দেশের সামন্তশক্তি বিধ্বস্ত হলো তখন বৌদ্ধ প্রতিষ্ঠানগুলিকে ও তাদের সঙ্গে সম্পর্কিত বৌদ্ধ শিল্পকলাকে স্থায়িত্ব দানের জন্য কোনো আর্থ-সামাজিক যৌক্তিকতা রইলো না। বিপর্যয়ের পরেও কিন্তু বৌদ্ধ গ্রন্থের অনুলিপি ও বৌদ্ধ দেবতাদের চিত্র তৈরির কাজ বিচ্ছিন্নভাবে চলছিল। আমরা দেখেছি, এই শিল্পকর্মের পরিমাণ অত্যন্ত সীমিত। মুসলমান আক্রমণের পর তের শতকের দিকে বাংলার কোনো কোনো অঞ্চলে মধুসেনদেবের মতো স্বাধীন বৌদ্ধ গৌড়েশ্বরের অস্তিত্ব থাকলেও পরবর্তী শতাব্দীগুলিতে বোধহয় এই রাজনৈতিক অবস্থার আরো পরিবর্তন ঘটেছিল। পনের শতকের মাঝামাঝি সময়ে দুটিমাত্র বৌদ্ধ গ্রন্থের অনুলিখন ও চিত্রণই সে কথার প্রমাণ দিচ্ছে। এ-ধরনের বিরল ও বিচ্ছিন্ন কাজ সম্ভব হয়েছিল বোধহয় ব্যক্তিগত পোষকতার ফলে। তবে বৌদ্ধ তান্ত্রিক সাধনা যে তখনো কোনো কোনো অঞ্চলে প্রায় আগের মতোই চলছিলো তার ভিন্ন ধরনের প্রথাও আছে। তের শতক থেকে ষোল শতকের মধ্যে কিছু সংখ্যক বৌদ্ধ গান বা চর্যাপদ রচনার বিষয়টি এ-প্রসঙ্গে স্বাভাবিকভাবেই গুরুত্ব পাচ্ছে। ষোল-সতের শতকে সহজিয়া বৌদ্ধগণ সহজিয়া বৈষ্ণব সম্প্রদায়ে সামাজিক প্রক্রিয়ার মধ্য দিয়েই মিশে গিয়েছিল। অতি সঙ্গত কারণে তখন থেকেই বৌদ্ধ গ্রন্থের অনুলিখন বা চিত্রণ জাতীয়, ধর্মীয় ও সাংস্কৃতিক ক্রিয়াকর্ম বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। পূর্ব-ভারতীয় পদ্ধতির চিত্রকলার প্রভাবে আলোচ্য যুগে কিছু সংখ্যক ১২-ন্দু পৌরাণিক গ্রন্থ চিত্রিত হচ্ছিল। কারণ হিন্দু ধর্মের স্থায়িত্বের জন্য প্রয়োজনীয় পাকাপোক্ত আর্থ-সামাজিক অবকাঠামো তখন দেশে ছিল। অন্য কোনো চিত্রকলার পদ্ধতি এ-অঞ্চলে তখনো প্রায় অনুপস্থিত। স্বাভাবিক কারণেই হিন্দু গ্রন্থাদি চিত্রণের ক্ষেত্রে বৌদ্ধ সংস্কৃতি প্রভাবিত, অবক্ষয়িত পূর্ব ভারতীয় চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি ঐতিহ্যিক উৎস হিসেবে কাজ করেছিল। ষোড়শ শতকের শরফনামায় উৎকীর্ণ ইরানী রীতির স্বল্প সংখ্যক চিত্রের আকস্মিক আবিক্রিয়ার পরেও মনে হচ্ছে যে, এই চিত্রাঙ্কন রীতি তখনো এদেশে ব্যাপকভাবে পরিচিতি লাভকরেনি।

Birth of Buddha, Ashtasahasrika-Prajnaparamita, c 983 AD

ইরানী রীতির চিত্রকলার উদ্ভব

পাল শৈলীর অনুসরণে তৈরী চিত্র নিদর্শনগুলি ছাড়া এক ভিন্ন রীতির চিত্র-শিল্পের নমুনা সম্প্রতি আবিষ্কৃত হয়েছে। নুসরৎ শাহের (১৫১৯-৩২খ্রিঃ) রাজত্বকালের একেবারে শেষ দিকে নিজামির সিকন্দরনামার বা শরফনামার চিত্রণের ঘটনা এদেশের শিল্পের ইতিহাসে অত্যন্ত তাৎপর্যবহ। বার তের বছর আগে আবিষ্কৃত ঐ পান্ডুলিপিটি এখন লন্ডনের ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত। মাত্র দশটি চিত্রের মধ্যে একটি বাদে অন্য সবগুলি চিত্রই আলেকজান্ডারের কৃতির সঙ্গে সম্পর্কিত। ভিন্ন প্রকৃতির চিত্রটি সংযুক্ত ধনুকের আকারে তৈরী কৌণিক প্রান্তবিশিষ্ট একটি মেডালিয়ন। অলঙ্কৃত মেডালিয়নটিতে উৎকীর্ণ লিপি থেকে জানা যাচ্ছে যে, হুসেইন শাহের পুত্র নুসরৎ শাহের আমলে ৯৩৮ হিজরিতে বা ১৫৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দে গ্রন্থটি জনৈক মাহমুদের পুত্র, হামিদ খান রূপে পরিচিত, আহমদ কর্তৃক অনুলিখিত হয়েছিল। আলেকজান্ডারের সঙ্গে যুদ্ধে হাবশীদের পরাজয়বরণ, দারার দূত কর্তৃক গ্রীক বীরকে পোলো খেলার বল ও ছড়ি এবং তিলের বীজ প্রদান, আলেকজান্ডার কর্তৃক দারাকন্যা রোশনাককে সাদরে গ্রহণ, তাঁর সঙ্গে রানী নওশাবার একত্রে সিংহাসনে উপবেশন, কায়খসরুর সমাধি দর্শন কালে সিংহাসনে উপবিষ্ট আলেকজান্ডারের মদ্যপান, চীনের খাকান কর্তৃক সিংহাসনোপবিষ্ট আলেকজাভারের আপ্যায়ন, যুদ্ধে রুশদেরকে পরাজিত করার কাজে রত আলেকজান্ডার এবং আলেকজান্ডার কর্তৃক রুশ রাজের আপ্যায়ন, জনৈক গুহাবাসী সাধুর সঙ্গে আলেকজান্ডারের সাক্ষাৎ এইসব হচ্ছে গান্ডুলিপির নয়টি পৃষ্ঠায় উৎকীর্ণ বিষয়বস্তু। চিত্রগুলি অন্তত দু’জন শিল্পীর আঁকা বলে অনুমিত হয়েছে। এ-কথার প্রমাণ আছে হাবশী বাহিনী ও রুশ সৈন্যদের সঙ্গে আলেকজান্ডারের যুদ্ধের ঘটনা নিয়ে আঁকা দুটি চিত্রে। হাবশীদের সঙ্গে যুদ্ধের দৃশ্যে অঙ্কিত পদাতিক ও অশ্বারোহী সৈন্যদের মূর্তিগুলি ক্ষুদ্রাকার ও পরিচ্ছন্ন। মনোজ্ঞ ভঙ্গিতে আঁকা অশ্বগুলি ভারতীয় চিত্রে দৃষ্টিগোচর ঘোড়ার মতো বিকৃত ও রীত্যায়িত নয়। রুশ বাহিনীর সঙ্গে আলেকজান্ডারের যুদ্ধের দৃশ্যে এবং আরো দুটি চিত্রে দিগন্তের ও-পারে দৃশ্যমান পটে এ-ধরনের ভারতীয় রীতিতে আঁকা অশ্ব দেখা যাচ্ছে। গুহাবাসী সাধুর সঙ্গে আলেকজান্ডারের সাক্ষাৎকার বিষয়ক চিত্রটিতে স্পষ্ট উজ্জ্বল রঙের সমন্বয়ে শৈল শ্রেণী যেন আকমিকভাবে ভূমিতল থেকে উদ্‌গত হয়েছে। Robert Skelton-এর ধারণা, এই চিত্র কোনো তৃতীয় শিল্পীর আঁকা। চিত্রটিতে অঙ্কিত ব্যতিক্রমধর্মী দৃশ্যে রহস্যময় পরিবেশ সৃষ্টির উদ্দেশ্যে পূর্বোক্ত দু’জন শিল্পীর মধ্যকার কোনো একজনই বোধহয় ঐ ধরনের শৈল অঙ্কনের রীতি অনুসরণ করেছেন। এ-ক্ষেত্রে তাঁর ঐতিহ্যিক উৎস হয়তো তের শতকের বাগদাদের চিত্রাঙ্কন পদ্ধতি। পনের ও ষোল শতকে ভারতে আঁকা আরো কোনো কোনো চিত্রে দৃষ্টিগোচর শৈল গঠনের এই বিশেষ রীতি বোধহয় ঐ একই উৎস থেকে চলে এসেছে।

মুখাকৃতি ও অবয়ব অঙ্কনে ভারতীয় ক্লাসিক্যাল রীতি ও গুজরাটি অপভ্রংশ রীতির কোনোটাই আলোচ্য শিল্পকর্মে সরাসরি অনুসৃত হয়নি। বেশীর ভাগ চিত্রে মুখ, অবয়ব ও হাত অতি কমনীয় ঋজু বা ঈষৎ আন্দোলিত রেখার সাহায্যে তৈরি। নাতিদীর্ঘ গ্রীবার উপর ডিম্বাকার বা সূঁচাল শ্মশ্রুযুক্ত মুখগুলি সন্নিবেশিত। ষোল শতকের প্রথম দিকে ইরানে আঁকা শিরাজের চিত্রে উৎকীর্ণ মূর্তিগুলির তুলনায় বাংলার আলোচ্য চিত্রগুলিতে মানুষের চেহারা অনেকটা ভারী। তবে ইরানী ঐতিহ্যের অনুসরণে পুতলি কয়েকটি ক্ষেত্রে আয়ত চোখের কোণার দিকে সন্নিবেশিত। এ-সব ক্ষেত্রে মানুষের চেহারা, বিশেষ করে মুখের গঠন ইরানী ঢঙের। ভারতীয় গড়নের মুখমন্ডলে পুতলির অবস্থান কিন্তু চোখের মাঝখানে।”

আকাশ সোনালী অথবা গভীর নীল রঙের। মেঘের রঙ লাল, কমলা অথবা সাদা। মেঘের প্রান্তভাগ সোনালী, নয়ত সাদা অথবা নীল। ঋষির সঙ্গে আলেকজান্ডারের সাক্ষাৎকার বিষয়ক চিত্রটিতে শৈলশ্রেণী আকস্মিকতার ব্যঞ্জনায় অনুরঞ্জিত। শৈলসারির রঙ সবুজ, নীল, ফিকে বেগুনী, কমলা ও বেগুনী। প্রত্যেক ক্ষেত্রে আছে একই রঙের ছিটে।

চিত্রগুলিতে দিগন্ত অঙ্কনের পদ্ধতি বিচিত্র। বেশীর ভাগ চিত্রে পরস্পর ছেদ-করা চাপের সাহায্যে দিগন্ত তৈরী। খাকান কর্তৃক আলেকজান্ডারের আপ্যায়নের দৃশ্যে দিগন্ত এই জাতীয় দুটি খিলানন্তরের মাধ্যমে গঠিত। অন্য একটি চিত্রে একটি মাত্র বক্র রেখা দিয়ে দিগন্ত প্রায় অর্ধবৃত্তাকার খিলানের মতো বাঁকানো। এই খিলানে চাপ-সম্পষ্টি অনুপস্থিত। দিগন্তগুলির প্রান্ত সাদা ও বাদামী রঙের পটি দিয়ে তৈরি। পটির প্রান্তরেখা নীল বর্ণের। সমকালীন ইরানী চিত্রকলায় অনেকগুলি অর্ধবৃত্ত বা চাপের সাহায্যে তৈরী দিগন্ত কমই দেখা যায়। গৌড়ে বসে যাঁরা চিত্রগুলি আঁকছিলেন তাঁরা ইরানের বিভিন্ন পদ্ধতির চিত্রকলায় দিগন্ত ও ছবির পটভূমিতে অবস্থিত পাহাড়-পর্বত অঙ্কনের রীতি ও কৌশলের সঙ্গে পরিচিত ছিলেন। মুজাফফরীয় রীতিতে শিরাজে আঁকা শাহনামার একটি চিত্রের (১৩৭১ খ্রিঃ) পটভূমিতে পরস্পর ছেদ-করা চাপের সাহায্যে তৈরী পাহাড়ের সারিতে এবং পরবর্তীকালে শিরাজে আঁকা অন্য একটি চিত্রে (১৪২০ খ্রিঃ) দুটি চাপের সমন্বয়ে তৈরী ঢেউ-এর মতো দিগন্তের সঙ্গে সঙ্গতি রেখে বিন্যস্ত করা শৈল শ্রেণীতে যেন শরফনামার চিত্রের দিগন্ত অঙ্কনের পূর্বাভাস খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। এ-ধরনের দিগন্ত পনের শতকের একটি তুর্কোমান চিত্রে আরো পরিস্ফুট হয়েছে।’ বাংলার চিত্রগুলিতে এই অঙ্কন পদ্ধতিই রীত্যায়িত। আলেকজান্ডারের সঙ্গে রুশ বাহিনীর যুদ্ধের দৃশ্যের ব্যতিক্রমধর্মী দিগন্তটি আঁকাবাঁকা রেখার সাহায্যে ঈষৎ আন্দোলিত। এ-ধরনের দিগন্ত-রেখার প্রায় অবিকল প্রতিরূপ দেখা যাচ্ছে ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে শিরাজে আঁকা সাদীর গুলিস্তানের একটি চিত্রে। তবে বাংলার চিত্রকলায় দিগন্ত ইরানী চিত্রের দিগন্তের তুলনায় ঈষৎ অবনত। শিরাজের কতকগুলি চিত্রে যেমন, আলোচ্য শিল্পকলার ক্ষেত্রেও তেমনি দু’ তিনটি ছবিতে দিগন্তের ওপার থেকে অশ্বারোহী সৈন্যগণ উকি মারছে।

আকাশে মেঘের দৃশ্যও রীত্যায়িত। শিরাজের চিত্রে মেঘগুলি কোনো কোনো ক্ষেত্রে ডিজাইনের মতো মনে হয় সারস যেন তার দীর্ঘ চঞ্চু দিয়ে মেঘ ধরছে। এ ধরনের রীত্যায়ন আলেকজান্ডার কর্তৃক কায়খসরুর সমাধি দর্শন বিষয়ক চিত্রে বিশেষভাবে লক্ষ্য করবার মতো। আলেকজান্ডারের সঙ্গে রুশ বাহিনীর যুদ্ধের দৃশ্যে সঞ্চারমান রঙীন মেঘ যুদ্ধক্ষেত্রের উত্তেজনার ও সৈন্যদের গতিশীলতার ব্যঞ্জনায় চিহ্নিত। অন্য কতকগুলি চিত্রে অঙ্কিত শান্ত প্রকৃতির দৃশ্যের সঙ্গে সঙ্গতি রক্ষা করে মেঘ যেন স্থির হয়ে আছে। শরফনামার চিত্রগুলিতে আঞ্চলিক বৈশিষ্টগুলি বিশেষভাবে প্রকাশ পেয়েছে কতকগুলি স্থাপত্যিক গঠনে, সজ্জায় ও ফলমূলের চিত্রণে। আলেকজান্ডার কর্তৃক দারাকন্যাকে অভ্যর্থনা জ্ঞাপনের দৃশ্যে ব্যবহৃত কৌণিক প্যাভিলয়ন, বহুগ্রন্থিযুক্ত বন্ধনীর উপর স্থাপিত বাঁকানো বর্ধিত ছাঁচা, হ্রস্ব, কুঞ্চিত গতিহীন চাপ-সমষ্টির সাহায্যে তৈরী খাঁজ-খিলান প্রভৃতি বাংলার তথা ভারতের স্থাপত্যেরই কতকগুলি উপাদান। কোনো কোনো চিত্রের চামর, মকর কেতন এবং সিলিং থেকে ঝুলানো পাংখা (ঝাড়-লণ্ঠন?) একান্তভাবেই ভারতীয়। কয়েকটি চিত্রে অশ্বের আদর্শায়িত মস্তক ও চোখ ও তার সজ্জার অঙ্কনে ভারতীয় প্রভাব স্পষ্টভাবেই প্রতিফলিত। দুটি চিত্রের বিন্যাসে সমান্তরাল প্যানেলের সাহায্যে সমগ্র দৃশ্যকে ভাগ করে দেখানোর ভারতীয় রীতি অনুসৃত হয়েছে।” রাজস্তানী চিত্রেও এ-জাতীয় বিভক্তিকরণের সাহায্যে দূরের দৃশ্যকে নিকটের দৃশ্যের উপরে স্থাপন করার রেওয়াজ দেখা যায়। ১২

তবে ব্যাপকভাবে দেখতে গেলে, আলোচ্য চিত্রগুলি ইরানী পদ্ধতির। উপরে আলোচিত বৈশিষ্টগুলিই সে-কথার প্রমাণ দিচ্ছে। সমকালীন বা প্রায় সমকালীন শিরাজে বিদ্যমান চিত্রাঙ্কন পদ্ধতির কতকগুলি বৈশিষ্ট্য শরফনামার চিত্রগুণিতে লক্ষ্য করবার মতো। দারার সঙ্গে আলেকজান্ডারের দ্বন্দ্ব সম্পর্কিত চিত্রটিতে অঙ্কিত ত্রিভুজাকার ক্ষেত্রের ডিজাইন ও সৌধের ফ্রীজে স্বর্ণপ্রত্রাবলীর (gold leaves) অলঙ্করণ পনের ও ষোল শতকের শিরাজে আঁকা চিত্রে দেখা যায়।” তবে মনে হয়, শিরাজ ছাড়াও বাগদাদসহ অন্যান্য কোনো কোনো স্থানের চিত্রাঙ্কন-পদ্ধতির প্রভাব এই চিত্রগুলোতে কমবেশী পড়েছে। প্রায় সবগুলো চিত্রেই আলেকজান্ডার আশেপাশের ব্যক্তি ও বস্তু-সমূহের তুলনায় কিছুটা উঁচুতে বা সিংহাসনে স্থাপিত। তাঁর চেহারাও বিশিষ্ট ও ব্যক্তিত্বসম্পন্ন। রাজকীয় ব্যক্তিত্বকে প্রতিফলিত করার এই সাসানীয়-মেসোপটেমীয়-ইরানী ঐতিহ্যের'” সঙ্গে বোধ হয় শরফনামার চিত্রকরগণ বিশেষভাবে পরিচিত ছিলেন।

প্রায় সমকালে ইরানে আঁকা আরো কতকগুলি চিত্রে শরফনামার চিত্রাবলীর সদৃশ শৈল্পিক বৈশিষ্ট্য খুঁজে পাওয়া যাচ্ছে। মিউনিকের Preetorious Collection – এ অন্তর্ভুক্ত একটি মিনিএচার চিত্রে শরফনামার অনেকগুলি বৈশিষ্ট্য পরিস্ফুট। এগুলি হচ্ছে উঁচু দিগন্ত, ধূসর পশমি বর্ণের সমতল ভূদৃশ্য, গভীর নীল রঙের ব্যবহার এবং এক ধরনের রঙমাখা সোনালী আকাশ। শরফনামার যুদ্ধের দৃশ্যে যেমন দেখা গেছে, এই চিত্রেও তেমনি আছে উত্তেজনাপূর্ণ সামরিক ক্রিয়াকর্মের পরিবেশ এবং লঘু পদক্ষেপে দ্রুতগামী সেনাদল। এ জাতীয় দৃশ্য প্রায়ই শিরাজ নগরীতে ষোল শতকের প্রথম দিকে চিত্রিত হচ্ছিল। ডাবলিন-এর Chester Beatty Library-তে সপ্তাক্ষিত, লিপিকর মুরশিদের তৈরী, নিজামীর খামসার একটি চিত্রিত পাণ্ডুলিপিতে (১৫২৯ খ্রিঃ) যুদ্ধের দৃশ্য আছে। শিরাজে এ জাতীয় পাণ্ডুলিপির বারবার বাণিজ্যিকভাবে চিত্রণ ঘটেছিল। এই ধরনের পান্ডুলিপি ষোল শতকের তিরিশ ও চল্লিশের দশকে ভারতে পৌঁছে গিয়েছিল। এই যোগসূত্রের দরুণ গৌড়ে শরফনামার মতো পান্ডুলিপির ইরানী রীতিতে চিত্রণ ও তাতে শিরাঙ্ক্ষীতির যুদ্ধের দৃশ্য অঙ্কন সম্ভব হয়েছিল। পনের-ষোল শতকে পশ্চিম এশিয়া ও ইরানের সঙ্গে ভারতের সমগ্র উপকূলীয় দেশগুলির বাণিজ্যিক সম্পর্ক বৃদ্ধি পেয়েছিলো। বিভিন্ন পণ্যের মতোই চিত্রিত পান্ডুলিপিও স্থলপথে ও সমুদ্র পথে ইরান থেকে গুজরাটে ও মালওয়ায় পৌঁছাতে পারতো। শরফনামাসহ উপরোক্ত বৈশিষ্ট্যের বিভিন্ন চিত্রিত পাণ্ডুলিপি বাণিজ্যিক লেনদেনের পথ ধরেই বাংলায় আসত। ইরানী চিত্রকলার ঐতিহ্যের সঙ্গে যোগসূত্র স্থাপন বাংলার পক্ষে তাই ছিল অনেকটা স্বাভাবিক।

ব্রিটিশ মিউজিয়মে সংরক্ষিত জামীর বিখ্যাত কাব্য ইউসুফ ওয়া জোলায়খার একটি চিত্রিত পান্ডুলিপির প্রথম পৃষ্ঠায় উৎকীর্ণ একটি মন্তব্য থেকে জানা যাচ্ছে যে, পাণ্ডুলিপিটি ৯১৩ হিজরীতে বা ১৫০৭-৮ খ্রিস্টাব্দে সুলতান আলা-উদ-দীন ইসকনদর শাহের গ্রন্থাগারের জন্য কেনা হয়েছিল। Nora Titley-র ধারণা, এই সুলতান আলা-উদ-দীন হোসেইন শাহ। তাঁর মতে ১৫০৫ খ্রিস্টাব্দের দিকে শিরাজে পাণ্ডুলিপি চিত্রণে যে রীতির প্রয়োগ দেখা যায় তাই বাংলায় ১৫০৭-৮ খ্রিস্টাব্দে চিত্রিত ফারসী পান্ডুলিপিটিতেও বিদ্যমান। ১৫৩১-৩২ খ্রিস্টাব্দে শরফনামা চিত্রিত হয়েছিল। ইউসুফ ওয়া জোলায়খা কাব্যে পরিলক্ষিত শিরাজের অঙ্কন-রীতির প্রভাবের আধিক্য সময়ের এই ব্যবধানে লোপ পেয়েছিল। তাই শরফনামার চিত্রগুলিতে কতকগুলি ভারতীয় বৈশিষ্ট্য প্রকট হয়ে দেখা দিয়েছে। দুটি পান্ডুলিপির মধ্যকার শৈল্পিক বৈসাদৃশ্য সম্বন্ধে এই মন্তব্য অত্যন্ত তাৎপর্যপূর্ণ। কিন্তু কতকগুলি কারণে বাংলার আলা-উদ-দীন হোসেইন শাহকে এই চিত্রকর্মের সঙ্গে যুক্ত করা মুশকিল। আলা অল-দীন ইসকনদর এই তিন শব্দের মধ্যে ইসকনদরই ব্যক্তি নামের নির্দেশক। ‘আলা অল-দীন’ কুনিয়া বা ব্যক্তিনামের সঙ্গে সংযোজিত উপাধিসূচক শব্দ। এ-ক্ষেত্রে সুলতান ইসকনদর আলোচ্য পাণ্ডুলিপি চিত্রণের সমকালেই জীবিত, দিল্লী ও জৌনপুর রাজ্যের সুলতান সিকনদর লোদীর সঙ্গে অভিন্ন। ‘ইসকনদর’ ‘সিকনদর’ শব্দেরই রূপান্তর। সিকনদর লোদী কর্তৃক অধিকৃত জৌনপুর নগরীতে অনুলিখিত ১৫০১ খ্রিস্টাব্দের একটি অপ্রকাশিত পাণ্ডুলিপির চিত্রগুলি ইরানী শৈলীর দুর্বল প্রাদেশিক সংস্করণ রূপে উল্লিখিত হয়েছে। কিসাস-উল-আম্বিয়া শীর্ষক আরো একটি অপ্রকাশিত পান্ডুলিপির ষোড়শ শতকীয় প্রাদেশিক শৈলীর চিত্রগুলিও জৌনপুরেই তৈরি বলে পন্ডিতদের ধারণা।” জৌনপুরে বিদ্যমান এই শৈল্পিক ঐতিহ্য ধর্তব্যের মধ্যে নিয়ে অনুমান করা যায় যে, ইউসুফ ওয়া জোলায়খা কাব্যের পান্ডুলিপিটি সিকনদর লোদীর সময়ে ষোল শতকের প্রথমদিকে জৌনপুরে চিত্রিত হয়েছিল।

Nora Titley শরফনামা ও ইউসুফ ওয়া জুলায়খা কাব্যের চিত্রগুলির মধ্যকার কতকগুলি সাদৃশ্য উল্লেখ করেছেন। শরফনামার চিত্রগুলির গভীর নীল রঙ ইউসুফ-জুলায়খার প্রেমাখ্যানে আঁকা চিত্রসমূহে সোনালী চাঁদ ও তারার এবং একটি ক্ষেত্রে বড়ো সোনালী মেঘখন্ডের পটভূমি রূপে ব্যবহৃত। শেষোক্ত গ্রন্থের একটি চিত্রে কতকগুলি অর্ধবৃত্তের দ্বারা তৈরী একটি হলুদ পটির সাহায্যে ঘন সবুজ ভূদৃশ্যের শৈলশ্রেণী নির্দেশিত হয়েছে। এই মোতিফই লক্ষ্য করা যাচ্ছে দারার দূতের কাছে থেকে আলেকজান্ডার কর্তৃক অবমাননাকর উপহার গ্রহণের দৃশ্যে। চিত্রটির পটভূমিতে একটি হলুদ রঙের বৃত্ত একটি তিলবীজ বৃক্ষের ঊর্ধ্বাংশ ঘিরে রেখেছে। রঙের ঔজ্জ্বল্যে ও অভিব্যক্তির আকস্মিকতায় যে শৈলশ্রেণী উভয় পাণ্ডুলিপিতে বৈচিত্র্য নিয়ে দেখা দিয়েছে, তাদের গঠনেও আছে উল্লেখযোগ্য সাদৃশ্যপূর্ণ বৈশিষ্ট্য।”

পাণ্ডুলিপি দুটির চিত্রের মধ্যে শৈল্পিক রীতির যোগসূত্র তো থাকতেই পারে। বাংলা ও জৌনপুর রাজ্য ছিল পরস্পর সংলগ্ন ভূখন্ডের উপর অবস্থিত। শেষ শর্কী সুলতান হোসেইন শাহের পরাজয়ের পর (১৪৯৪ খ্রিঃ) প্রায় সমগ্র শর্কী রাজ্য সিকনদর লোদীর অধিকারে চলে গেলেও কোলং বা ভাগলপুর এলাকা বাংলার অন্তর্ভুক্ত হয়ে গিয়েছিল। ভাগলপুরেই হোসেইন শর্কী কবি সাহিত্যিক ও শিল্পীদের সঙ্গে করে আশ্রয় নিয়েছিলেন। নুসরৎ শাহের সময়ে বাংলার সীমানা ত্রিহত ছাড়িয়ে ঘোঘরা-গঙ্গার সঙ্গমস্থল পর্যন্ত এগিয়ে গিয়েছিল। এক্ষেত্রে শৈল্পিক রীতির আদান-প্রদান ছিল একটি স্বাভাবিক প্রক্রিয়া। উপরে উল্লিখিত জৌনপুরে অঙ্কিত, ষোড়শ শতকীয় চিত্রগুলি প্রকাশিত হলে এই শৈল্পিক লেনদেনের বিষয়টি বোধহয় স্পষ্টভাবে বুঝতে পারা যাবে।

ইউসুফ ওয়া জোলায়খা কাব্যের চিত্রগুণিতে শিরাজে বিদ্যমান অঙ্কন-পদ্ধতির ঐতিহ্যিক বৈশিষ্ট্যগুলি বিশেষভাবে পরিস্ফুট। ব্রিটিশ লাইব্রেরীতে সংরক্ষিত, ১৫১৩ খ্রিস্টাব্দে আঁকা সাদীর গুলিস্তানের চিত্রের সঙ্গে এই চিত্রগুলির তুলনা করলে উক্ত সাদৃশ্যের বিষয়টি বোধগম্য হবে। তন্বী দেহ, গোলাপী রঙের ডিম্বাকার মুখমন্ডল, ঈষৎ আয়ত চোখের কোণায় স্থিত পুতলি, লতাপাতা ও গাছ-গাছড়ার হালকা অবয়ব, উঁচু দিগন্ত প্রভৃতি দুটি কাব্যের চিত্রেই দেখা যাচ্ছে। Nora Titley-র গ্রন্থে প্রকাশিত ৩৩ সংখ্যক রঙীন প্লেটের পিগমেন্টের গাঢ় নীল বাদ দিলে উভয় ক্ষেত্রে ব্যবহৃত রঙের প্রকারভেদ একই রকম।

জৌনপুর ও বাংলায় যোল শতকের প্রথম দিকে আঁকা কতকগুলি চিত্রে শিরাজের অঙ্কন-রীতিসহ অন্য কোনো কোনো রীতির প্রভাব লক্ষ্য করা গেল। পনের ও ষোল শতকে মালওয়ায় আঁকা কতকগুলি চিত্রে হিরাটের ও শিরাজের অঙ্কন-শৈলীর প্রভাব স্পষ্ট।” এই চিত্রগুলির কোনো কোনোটিতে পশ্চিম ভারতের গুজরাটি বা অপভ্রংশ রীতির মৃদু প্রভাবও চোখে পড়ে। কিন্তু জৌনপুর ও বাংলার চিত্রগুলিতে আঞ্চলিক পূর্ব-ভারতীয় চিত্রকলার প্রভাব নেই। আলোচনার শুরুতেই আমরা পূর্ব ভারতীয় রীতির চিত্রশিল্পের ক্ষীয়মান ও প্রায় অবলুপ্ত ঐতিহ্যের কথা উল্লেখ করেছি। এ ধরনের ঐতিহ্য স্বাভাবিক কারণেই শরফনামা ও ইউসুফ ওয়া জোলায়খার চিত্রাবলীয় অঙ্কন-শৈলীকে প্রভাবিত করতে পারেনি।

ইরানী রীতির প্রভাবে তৈরী উপরোক্ত চিত্রগুলির অস্তিত্ব থেকে বুঝতে পারা যায় যে, বাংলার ও জৌনপুরের সুলতানগণ পারস্য থেকে ফারসী কাব্য আনিয়ে তার প্রতিলিপি তৈরি করাতেন। পাণ্ডুলিপি চিত্রণের জন্য প্রয়োজন অনুযায়ী তাঁরা বিদেশী চিত্রকরদের পোষকতা দিতেন। পৃষ্ঠপোষক সুলতানের আকস্মিক মৃত্যু ও রাষ্ট্র বিপ্লব জাতীয় কারণে ইরানী ধারার এই চিত্রাঙ্কন রীতি তার পরিণতি খুঁজে পায়নি।

আমরা দেখলাম, সুলতানী আমলের বাংলায় তাল পাতার সঙ্গে সঙ্গে চিত্রাঙ্কনের কাজে কাগজ ব্যবহৃত হচ্ছিল। পাটায় বা কাঠের মলাটে আঁকা চিত্রের কিছুটা ব্যাপকতা লক্ষ্য করা যায় সতের-আঠার শতকে। ষোল শতকে আঁকা পাটাচিত্র বিরল। চিত্রগুলির বিষয়বস্তুতে পুনরুজ্জীবিত বৈষ্ণববাদের প্রভাব অত্যন্ত প্রবল। স্থানীয় হিন্দু জমিদারদের পোষকতায় তৈরী এই চিত্রগুলি রেখা-নির্ভর দ্বিমাত্রিক এবং বর্তনাবিহীন বা সমতল। শরীর গঠনে, বিশেষ করে টানা চোখের ভঙ্গিতে ও পোষাকে দৃষ্টিগোচর রাজপুত প্রভাব। ২২ কতকগুলি চিত্রে ওড়িশার পুঁথিচিত্রের ঐতিহ্যিক আভাস লক্ষ্য করবার মতো। অতি ব্যাপক ও গুরুত্বপূর্ণ একটি আর্থ-সামাজিক প্রক্রিয়া এই পূর্ব-ভারতীয় চিত্রশিল্পের ইতিহাসে ধারাবাহিকতা রক্ষায় সহায়ক হয়েছিল। ষোল শতক থেকে শুরু করে চৈতন্যের বৈষ্ণববাদ বেশ কয়েক শতাব্দী ধরে বাংলার সমাজ-সংস্কৃতির অনেকগুলি ক্ষেত্রকে সঞ্জীবিত করেছিল। বৈষ্ণববাদের সঙ্গে অবিচ্ছিন্নভাবে সম্পর্কিত কৃষ্ণলীলা ও চৈতন্য-জীবনীর বহু উপাদান ও অনুষঙ্গ চিত্রশিল্পের বিষয়বস্তু রূপে গৃহীত হয়েছিল। সমকালের শিল্লিগণকে পোষকতাও দিতেন বৈষ্ণব রাজন্য ও বৈষ্ণব বণিক শ্রেণী। দরবারি পোষকতায় লালিত, ঔপনিবেশিক ঐতিহ্যে দৃঢ়মূল, পূর্বোক্ত ইরানী রীতির চিত্রশিল্প এধরনের ব্যাপক ও সৃজনশীল আর্থ-সামাজিক প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্ক গড়ে তুলতে পারেনি। তাই তার বিলোপ ছিল অনিবার্য। এমন মনে হতে পারে যে, সুলতানী চিত্রকলার জের টেনেই আঠার শতকে মুরশিদাবাদের নবাবী দরবারকে কেন্দ্র করে একটি মোগল চিত্ররীতির ঘূরণ ঘটেছিল। যোল শতক থেকে শুরু করে পরবর্তী কালে তৈরী, ইরানী রীতির চিত্র নিদর্শনের দুষ্প্রাপ্যতার কথা মনে রাখলে এ-অভিমত গ্রহণযোগ্য বলে মনে হয় না।

তথ্য-নির্দেশ:

১. সরসীকুমার সরস্বতী, পাল যুগের চিত্রকলা (আনন্দ পাবলিশার্স প্রাইভেট লিমিটেড, কলকাতা, ১৯৭৮), ১৬২-৭০; চিত্র-সংখ্যা ৩৩-৪১

২. R. Skelton, “The Iskandar Nama of Nusrat Shah,” Indian Painting (London, Colnaghi, 1978), 135-52

৩. N. M. Titley, Persian Miniature Painting and Its Influence on The Art of Turkey and India: The British Library Collections (London, The British Library, 1983), 179

8. Skelton, পূর্বোক্ত, 148 পৃষ্ঠায় সংযোজিত চিত্র।

৫. ঐ, 140; fn. 24; Titley, 183

দুই শ্রেণীর মুখমন্ডলের এই বৈশিষ্ট্যটিকে Titley বিশেষ গুরুত্বের সঙ্গে আলোচনা করেছেন; ঐ, 162, 180

৭. উপরোক্ত তিনটি চিত্রের জন্য ঐ, Figs. 16,21,31

৮. চিত্র দুটির জন্য যথাক্রমে Skelton, 143 পৃষ্ঠায় সংযোজিত চিত্র এবং Titley p.

97; Pl. 13.

১. ঐ, 92

১০. 149 পৃষ্ঠার চিত্র।

১১. এই বৈশিষ্ট্যগুলি Skelton বিশেষভাবে উল্লেখ করেছেন; ঐ, 140 এবং 141 ও 147 পৃষ্ঠার চিত্র।

১২. K. Khandalavala, “The Origin And Development of Rajasthani Painting”, Marg. XI (1958), No-2

M. R. Tarafdar, Illustration of the Chandain In The Central Museum Lahore”, Journal of the Asiatic Society of Pakistan. VIII (1963), No 2; দ্রষ্টব্য Pls. I-XI.

১৩. Titley, 180; Pl 32 (p. 177)

১৪. ঐ, 12, 14, 16, 36, 162; Fig. 58

১৫. তথ্যগুলি জন্য ঐ, 180, 181

১৬. 4, 182, 183

১৭. Skelam, 136, fin 12. 176. নিজামীর অন্য একটি ইসকনদরনামার (১৫০০ খ্রিঃ) সুলতানী আমলের চিত্রগুণিকে উত্তর-ভারতীয় আধ্যা দেয়া হয়েছে। একটি টিত্রে দৃষ্টিগোচর কুসাদার পাগড়ী ও সূঁচাল স্মণযুক্ত মুখ শরফনামার কোনো কোনো চিত্রের সঙ্গে সাদৃশ্যবহুল। এই চিত্রগুণিও বোধহয় জৌনপুর অবলেই তৈরি হয়েছিল। Toby Falk, “Mughal and Rajput Painting,, P. 77; সংখ্যক

১৮. ঐ, 183

১৯. M. R. Tarafdar, Husainshahi Bengal: A Socio-Political Study (Dacca, Asiatic Society of Pakistan, 1965), 38-40, 74, 77

২০. তুলনীয় Titley-র গ্রন্থের 97 পৃষ্ঠার 11.13 সোনীর বুস্তানের চিত্র) এবং 188 পৃষ্ঠার 11.33 (ইউসুফ জুলায়খার চিত্র)?

২১. পনের শতকের শেষ দিকে ও যোল শতকের প্রথম দিকে মালওয়ার মাণ্ডুতে চিত্রিত গ্রন্থগুলি হচ্ছে সাদীর মুস্তান, নিয়ামতনামা, মিফতাহ-উল-ফুজুলা ও আজাইব-ই-সানামী। দ্রষ্টব্য R. Ettinghausen, “The Bustan Manuscript of Sultan Nasir Shah Khalji” Marg, XII (1959), No. 3, 40-43; R. Skelton, “The Niyamat Nama A Landmark in Malwa Painting 44-48; Tuley, পূর্বোক্ত গ্রন্থ, 171-76

২২. M. R. Tarafdar, A General Guide To The Dacca Museum (Dacca, 1964), 48-50; Pl. 14 

২৩. রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায়, “মধ্য যুগের বাংলার চিত্রকলা, অনিরুদ্ধ রায় ও রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায় সম্পাদিত, মধ্য যুগে বাংলার সমাজ ও সংস্কৃতি (কলকাতা, ১৯৯২), ২৫৬।

২৪. মুরশিদাবাদ চিত্রনীতির জন্য দ্রষ্টব্য Robert Skelton, “Murshidabad Painting”, Marg X (1956), ১০-২১। মুশিদাবাদের চিত্ররীতি গড়ে উঠেছিল মূলত মোগল আঙ্গিকের অনুসরণে।

২৫. রত্নাবলী চট্টোপাধ্যায়, পূর্বোক্ত, ২৫২-৫৩

(প্রথম প্রকাশঃ চারুকলা, প্রথম বর্ষ, প্রথম সংখ্যা, ফেব্রুয়ারি ১৯৯৪)