গুহাচিত্র প্রাগৈতিহাসিক যুগের শিল্পকর্ম। গুহাচিত্র বলতে সাধারণত প্রাচীন গুহাতে প্রাপ্ত বিভিন্ন চিত্রকে বোঝায় যা গুহার দেয়ালে বা ছাদে আদিম মানুষদের দ্বারা চিত্রিত। গুহাচিত্র পৃথিবীর বিভিন্নপ্রান্তে ছড়িয়ে আছে। এ পর্যন্ত আনুমানিক প্রায় ৪০০ এর মত গুহাচিত্রের স্থান খুঁজে পাওয়া গিয়েছে। এর মধ্যে স্পেন ও ফ্রান্সে বেশিরভাগ গুহাচিত্রের অবস্থান। অধিকাংশ গুহাচিত্রগুলিতে ম্যামথ, ঘোড়া, বলগা হরিণ, ষাঁড় আঁকা হয়েছে।
আনুমানিক ৪০ হাজার থেকে ১৫ হাজার বছর আগে পৃথিবীতে যখন তুষারযুগ ছিলো তখনই মূলত প্রাগৈতিহাসিক মানুষের ভেতরে চিত্রনির্মাণের মানসিকতা গাঢ় থেকে গাঢ়তর হয়। ইউরোপের বিভিন্ন অঞ্চলে প্রায় ৩৫ হাজার বছর পূর্বের গুহাবাসি মানুষের বসবাসের অনেক তথ্য-উপাত্ত খুজে পাওয়া গেছে।
কেন গুহাচিত্র আঁকা হতো এই প্রশ্নের উত্তর খুজতে গেলে যে বিষয়টি স্বচ্ছ হয়ে আসে তা হচ্ছে প্রাগৈতিহাসিক মানুষদের যাদুবিশ্বাস। শিকারী জীবনে প্রবেশ করার পূর্বমুহুর্ত পর্যন্ত মানুষ ছিল প্রকৃতির কাছে অসহায়। আর এই অসহায়ত্বের কারনেই অগ্নি, বায়ু এবং পানির কাছে নিজেকে সমর্পন করে মানুষ আর মহাশক্তির রূপক কল্পনা করে বিশ্বাস এবং প্রার্থণা করার প্রক্রিয়ায় প্রবেশ করে। সূচনা ঘটে যাদু বিশ্বাসের। হাতিয়ার আবিস্কারের জ্ঞান অর্জনের মধ্য দিয়েই মানুষ তার টিকে থাকা নিশ্চিত করে এবং সামনের সময়ের জন্য প্রস্তুত হয়। আর এই প্রস্তুতির জন্য তাদের কিছু কিছু বিশ্বাসকে আচারিক করে তোলে এবং নানা অনুষ্ঠানাদির মধ্য দিয়ে এই বিশ্বাসগুলোকে তারা জীবনের সাথে প্রামাণ্যকর্ম হিসেবে যুক্ত করে ফেলে।
একদিকে ক্ষুধা আরেকদিকে নিরাপদে বেঁচে থাকা মূলত এই দুইটি কারনেই তাদের যাদুবিশ্বাস তাদের জীবনগতির সাথে পালিত হতে থাকে। হিংস্র প্রাণীর থাবা থেকে নিজেকে রক্ষা করার এবং পশু শিকার করে নিরাপদে ফিরে আসার জন্যও তারা যাদুবিশ্বাসের শরনাপন্ন হতো। তারা বিশ্বাস করতো যে প্রাণীর ছবি নিখুতভাবে আঁকা হবে সেই প্রাণী যতই হিংস্র হোক সেই প্রাণী দ্বারা কোনো ধরণের ক্ষতির স্বীকার হবেনা। পশুশিকারে যাবার পূর্বে তারা পশুর ছবি একে তার চারপাশে দলবেঁধে প্রদক্ষিণ করতো এবং তীরবিদ্ধ করতো। আবার দেয়ালে বন্যপ্রাণীর ছবি এঁকে তাতে তীরবিদ্ধ করা হতো। কারন হচ্ছে তারা মনে করতো এতে করে তারা পশু শিকারে গেলে পশুকে খুব সহজে শিকার করতে পারবে এবং নিরাপদে ফিরে আসতে পারবে।
প্রাগেতিহাসিক মানুষেরা গুহার গভীরে চিত্র রচনা করতো; কারন তাঁরা মনে করতো যে গুহার অভ্যন্তরে ছবি আঁকা থাকলে সেইসকল হিংস্র প্রাণী গুহায় প্রবেশ করবে না এবং তারা নিরাপদে থাকতে পারবে।
দ্য কুয়েভা দে লাস মানোস

আর্জেন্টিনার সান্তা ক্রুজ প্রদেশে অবস্থিত দ্য কুয়েভা দে লাস মানোস। স্প্যানিশ ভাষায় যার অর্থ ‘হাতের গুহা’ এবং যা ‘কেইভ অব হ্যান্ডস’ নামেও পরিচিত। গুহাটিতে প্রায় ৯ হাজার থেকে ১৩ হাজার বছর আগে আর্জেন্টিনার পাতাগোনিয়া অঞ্চলের আদিম মানুষের আঁকা অসংখ্য হাতের চিত্রের কারণেই এর এই নামকরণ। তবে শুধুমাত্র হাতের চিত্রই নয়; অঙ্কিত এই গুহাটির দেয়ালে রয়েছে বিভিন্ন প্রাণী, শিকারের দৃশ্য, জ্যামিতিক নকশাসহ বিভিন্ন আঁকাবাঁকা নকশা। গুহাটিকে ১৯৯৯ সালে ইউনেস্কো বিশ্ব ঐতিহ্য হিসেবে ঘোষণা করে।
তবে অবাক করার বিষয়-এই গুহায় যতগুলো হাতের চিত্র রয়েছে তার বেশিরভাগই বাম হাতের চিত্র। প্রত্নত্বাত্ত্বিকদের ধারণা- সেকালের মানুষেরা তাদের ডান দিয়ে বাম হাতের উপর রং ছিটিয়ে এই চিত্রগুলো এঁকেছিলো বা ছাপ দিয়েছিলো। হাতে রঙ ছিটানো হয়েছিলো হাড় দিয়ে তৈরি পাইপ দিয়ে। রঙ তৈরিতে ব্যবহার করা হয়েছিলো প্রাকৃতিক খনিজ রঞ্জক পদার্থ, যেমন- ম্যাঙ্গানিজ অক্সাইড (কালো), চীনামাটি (সাদা), আয়রন অক্সাইড (লাল, রক্তবেগুনী)। রঞ্জক স্প্রে করে হাতের চিত্র তৈরি করতো।
এখন পর্যন্ত এই গুহাচিত্রটি বিশ্বের সবচয়ে দীর্ঘ এবং বিস্ময়কর হাতের ছাপ। এই হাত দিয়ে আসলে কি বোঝানো হচ্ছে তার উত্তর কারও জানা নেই। তবে একটি তত্ত্ব বলে- কিশোরদের দীক্ষা অনুষ্ঠান বা ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে এই হাতগুলো আঁকা হতো। কারণ বেশিরভাগ হাতই কিশোরদের। বড়দের হাতের সংখ্যা খুব কম। অন্য একটি তত্ত্ব মতে, শিকারে যাওয়ার আগে ধর্মীয় অনুষ্ঠানের অংশ হিসেবে এই হাতগুলো আঁকা হয়েছিলো।
আলতামিরা গুহা

আলতামিরা গুহা স্পেনের উত্তরাঞ্চলের কান্তাব্রিয়া অঞ্চলে অবস্থিত। ১৮৬৮ সালে আবিষ্কৃত এ গুহাটি প্রায় ৩৩০০ ফুট দীর্ঘ। বাইসন, বন্য ঘোড়া, বুনো শূকর, ছাগল ইত্যাদির এ গুহাচিত্রের বিষয়বস্তু। এটিই ছিল প্রথম গুহা যেখানে প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্র আবিষ্কৃত হয়েছিল।
আলতামিরা বাইসন চিত্রকর্মটি আলতামিরার গুহায় পাওয়া কাজের বড় সিরিজের একটি অংশ। এই গুহাচিত্রগুলো প্রায় ১৭ হাজার থেকে ১২ হাজার বছর আগের। এই সময়কালটি আপার প্যালিওলিথিক বা ম্যাগডালেনিয়ান যুগ হিসাবে পরিচিত। ম্যাগডালেনিয়ান যুগকে আবার ‘এজ অব দ্য রেইনডিয়ার’ নামেও ডাকা হয়।
ম্যাগডালেনিয়ান চিত্রশিল্পীরা তাদের পূর্বসূরিদের তুলনায় অনেক বেশি পরিমাণে রঙিন রঞ্জক ব্যবহার করেছেন; যা খনিজ মাটি এবং অন্যান্য প্রাকৃতিক যৌগ দিয়ে তৈরি করা হয়েছিল। প্রধানত ব্যবহৃত রং হল লাল, কালো এবং সাদা। লাল রঙ সাধারণত আয়রন ডাই অক্সাইড ব্যবহার করে তৈরি করা হয়েছিল। কালো রঙ তৈরি করেছিল কাঠ-কয়লা বা ম্যাঙ্গানিজ দিয়ে। সাদা রঙটি প্রাকৃতিক চক, কেওলিনাইট কাদামাটি বা ডায়াটোমাসিয়াস মাটি থেকে তৈরি করা হয়েছিল। এরপর সেগুলো পানি, পশুর চর্বি, রক্ত বা ডিমের কুসুমের মতো তরল দিয়ে মিশ্রিত করে ব্রাশ বা আঙুল ব্যবহার করে রঙ করা হতো। এছাড়াও সেইসময় স্প্রে পেইন্টিং কৌশলগুলোও ব্যবহৃত হত বলে জানা যায়, উদাহরণস্বরূপ, দেয়ালে রাখা একটি হাতের উপর একটি হাড়ের বা ফাঁপা কা-ের টিউবের মাধ্যমে মুখ দিয়ে শুকনো
ছবিতে বেশ সাজানো গোছানো একটি বাইসন দেখা যাচ্ছে। একপাশ থেকে আঁকা হয়েছে যেখানে রংয়ের সাথে রেখার গুরুত্বও প্রকাশ পেয়েছে। রেখার দৃঢ়তা এবং ঋজুতাই বিষয়ের গতিকে স্থির করে দিয়েছে। চিত্রক্ষেত্রের বিভিন্ন স্থানে লাল এবং খয়েরি রংয়ের অপ্রয়োজনীয় ব্যবহার লক্ষনীয়। থেকে ধারণা করা যেতে পারে যে কাঁচা রং ব্যবহারের সময় শিল্পি ইচ্ছাকৃত ভাবে তা করেননি। তবে লাল এবং কালোর প্রবাহে ছবির ভাষা নান্দনিক এবং মূলত সেই সময়ের সামাজিক তাৎপর্যকে উপস্থাপন করে।
লাসকো গুহা

লাসকো গুহাচিত্র ১৯৪০ সালে আবিষ্কৃত হয়। প্রায় ৬০০টি চিত্র রয়েছে এই গুহাটিতে। অধিকাংশ ছবিতে লাল, হলুদ ও কালো রঙ বিদ্যমান। রঙগুলো তৈরিতে ব্যবহার হয়েছে খনিজ উপাদান, কয়লা, খড়িমাটি ইত্যাদির সাথে পশুর চর্বি। ১৯৬৩ সালে গুহাচিত্র সংরক্ষণের উদ্দেশ্যে গুহাটি বন্ধ করে দেয়া হয়। ১৯৭৯ সালে ইউনেস্কো লাসকো ও তার আশেপাশের গুহাগুলোকে ‘ওয়ার্ল্ড হেরিটেজ সাইট’ হিসেবে ঘোষণা করে।
লাসকো গুহার একটি দেয়ালকে বলা হয় ‘দ্য গ্রেট হল’ যেখানে ৩৬টি প্রাণীর ছবি আছে যার মধ্যে ষাঁড়, ঘোড়া আর হরিণের ছবি প্রধান বিষয়বস্তু। এর মধ্যে একটি ষাঁড়ের ছবির আকার হলো শিং থেকে লেজ পর্যন্ত ১৭ ফুট। এই ছবিটি এই গুহাচিত্রের মধ্যে সবচেয়ে বড় আকারের চিত্র।
এই চিত্রকর্মটি আকা হয়েছে গুহাটির ছাদে। দেখলে মনে হবে ঘোড়া এবং ষাড়গুলো মাথার উপরে আকাশজুড়ে ছুটে চলেছে। ভাবতেও অবাক লাগে এ ছবিটি এমন একটি সময়ে আকা হয়েছিল যে সময় আমাদের র্প্বূপুরুষরা মই কিংবা পেইন্টিং প্ল্যাটফর্ম তৈরিতে দড়ি বা পুলির ব্যবহার জানতো না। এই চিত্রকর্মটিতে বেশ কয়েকটি রংয়ের ব্যবহার লক্ষনীয়, যেমন লাল, কালো গাঢ় হলুদ, খয়েরি এবং হালকা ছাই রং। বিভিন্নমুখি বাইসনগুলোকে একটু গতিশীল করে বিন্যাস করা হয়েছে। লাল রংয়ের ব্যবহার একটু বেশী হলেও খয়েরী রংয়ের ব্যবহার এবং কালো রঙের অল্পবিস্তর আস্তরণে বেশ প্রাণময় হয়েছে এই গুহাচিত্রটি। চিত্রের নীচের বামদিকের ছোট বাইসনের গতি অন্য বাইসনগুলোর চেয়ে অনেক বেশী। কাঠি সদৃশ রেখার মাধ্যমে মানুষের ফিগারকে আকা হয়েছে যা বাইসনের তুলনায় অনেকগুণ ছোট।