অনূভূতির প্রবণতায় শিল্পের আধুনিকতা

Mustafijur Rahman

Sub Editor, Art Criticism bd

মানুষ ক্রমেই নিজেদেরকে পরিবর্তন, পরিবর্ধনের মাধ্যমে পূর্বের অবস্থান থেকে আরও একটু উন্নততর পর্যায়ে পৌঁছানোর চেষ্টা অব্যাহত রাখে; যার প্রকাশ পায় সৃজনশীল কর্মকা-ের মধ্য দিয়ে। সেই প্রাগৌতিহাসিক গুহাবাসি মানুষ থেকে আজ অবধি শিল্পের মধ্য দিয়ে মানুষের বিকাশপর্বকে নির্ধারণ করেছে সৃষ্টিশীল মানুষ। সৌন্দর্য বোধের পরিবর্তিত রূপ শিল্প চর্চার ধরণকে পরিবর্তিত করেছে আর তাইতো গুহা থেকে বর্তমান গ্যালারি পর্যন্ত শিল্পের জার্নিটা অনেক বৈচিত্র্যময় গতিশীল এবং আধুনিক।
আধুনিক শিল্পকলা: আধুনিক শব্দটি বহুল ব্যবহৃত ও পরিচিত। কিন্তু তারপরও এর অর্থ নিয়ে বিভ্রান্তিতে পড়ার যথেষ্ট সম্ভাবনা রয়েছে। আর তার কারণ হলো অভিধান। অভিধানে বলা হয়েছে আধুনিক অর্থ বর্তমান কালের, হালের, সাম্প্রকিত, নব্য, অধুনাতা প্রভৃতি। অভিধানের এ অভিমত অনেককেই বিভ্রান্ত করে। তারা ভাবেন বর্তমান বা সাম্প্রতিক সময়ই হচ্ছে আধুনিক সময় কিন্তু শতবর্ষ আগের কিংবা তারও আগের শিল্পকর্ম যে আধুনিক সে কথা তারা ভাবতে পারে না। আজকে যে সময়কে প্রাচিন বলা হচ্ছে প্রকৃত অর্থে সে সময়ও সেই সময়কালে আধুনিক ছিল। আধুনিক শব্দটি মূলত গতি শব্দের সাথে সম্পর্কযুক্ত। সভ্যতার প্রতিটা যুগেই আধুনিকতার স্পর্শ লেগেছে। মুক্ত মন, উদার নীতি, স্বাধীন শিক্ষা এবং শিল্প সংস্কৃতির গতি ও প্রগতির সাথে যারা যত বেশি একাত্ব হতে পারে তাদেরকে তত বেশি আধুনিক মানুষ হিসাবে চিহ্নিত করা যায়। আভিধানিক ব্যাখ্যার দৃষ্টিকোন থেকে গুহা যুগের অশিক্ষিত ও অসভ্য মানুষদের সৃষ্ট শিল্পকর্মকে সেই যুগের জন্য আধুনিক শিল্পকর্ম বলা যেতেই পারে। কিন্তু আজকের তুলনায় সে যুগের শিল্পকর্ম অবশ্যই প্রাচীন শিল্প হিসেবে বিবেচিত হবে। অতীতের শিল্পকর্ম এ জন্যই একইসাথে প্রাচীন এবং আধুনিক।
শিল্পের আধুনিকতা: “শিল্পের আধুনিকতা” বিষয়টা ঠিক কখন থেকে বা কীভাবে আসলো আর কিভাবেই বা একটি চিত্রকর্ম আধুনিক রূপকে ধারণ করে থাকে। বা আধুনিক রূপকে ধারন করবার অথবা নির্মাণ করবার মূল রসটা কী। বিষয়ের উপস্থাপনে একটি চিত্রকর্ম আধুনিক হয়ে ওঠে নাকি নির্মানের কৌশলে। এই বিষয়গুলো অনেকগুলো চিন্তাপ্রসূত বাস্তব ভিত্তির উপর দাঁড়িয়েছে। কারণ আমরা স্পেনের আলতামিরা গুহার প্রাগৈতিহাসিক গুহাচিত্র দেখেছি। পৌরানিক ভাস্কর্য দেখেছি, অজন্তা ইলোরার পাথর খোদাইকৃত শিল্পকর্ম দেখেছি। কিন্তু এসব শিল্পকর্মকে আমরা আধুনিক বলছি না। আধুনিক বলছি পিকাসোর ঘনক ফর্মের চিত্রমালাকে যেখানে ফর্মের ভাঙা গড়া হয়েছে। যেমন জ্যাকসন পুলকের চিত্রমালা যেখানে বৃহৎ পরিসরে রংএর গতিপ্রবাহ তৈরি করা হয়েছে। সেগুলোকে আধুনিক চিত্রকলা বলছি। আমরা আধুনিক বলছি এস এম সুলতানের আঁকা পেশীবহুল খেটে খাওয়া সাধারণ মানুষগুলোকে ; যোগেন চৌধুরীর রেখাপ্রধান ভয়ঙ্কর প্রতিকৃতি বা দেহসৌষ্ঠবের চিত্রমালাকে আধুনিক চিত্রকর্ম বলছি। আবার বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের চিত্রকর্মগুলোকে ভারতীয় আধুনিক চিত্রকলার সূচনা সৃষ্টি হিসেবে আখ্যায়িত করছি।
আধুনিক চিত্র চর্চার পূর্বে চিত্রকলা নির্মাণের নেপথ্যে ছিল শুধুই দৃশ্যরূপের অনুকরণ, কখনো পৌরানিক স। এর বাইরে কিছু এভাবে ভাবা হতো না। সময়ের আবর্তনে শিল্পির চিন্তার পরিবর্তন ঘটলো। দৃশ্যরূপের পাশাপাশি অনুভূতির আশ্রয় প্রশ্রয় ঘটলো। অদেখা রূপকে দেখার প্রবণতা তৈরী হলো। অরূপের ভিতরে রূপকে নিয়ে আশা হলো।
রাজনৈতিক, সামাজিক, অর্থনৈতিক এবং ভৌগোলিক অস্থিরতা ভাব বোঝার মধ্য দিয়ে রূপ নির্মাণে শুরু হয়ে গেল। গভীর থেকে অনুভূতির আরোও গভীরে যেতে লাগল সৃষ্টি প্রাণ। ধ্বংস আর সৃষ্টির মাঝে তৈরি হলো মেলবন্ধন। এভাবেই চিত্রকলাতে আধুনিকতার ছোঁয়া লাগল। এই আধুনিকতা মূলত চিন্তার আধুনিকতা বা চিন্তা শক্তির গভিরতা।
জীবন, ধর্ম, সৌন্দর্যচিন্তা, প্রেম, ভালোবাসা, প্রকৃতি এই সবকিছুই দৃশ্য শিল্পের অন্তর্গত। এই দৃশ্যরূপ এবং অনুভূতি একসাথে জীবনের শিল্পিত রূপকে উপস্থাপন করে। দৃশ্যরূপ এবং অনুভুতির যে মিলন এবং এই দু’য়ের মধ্য দিয়ে যে সৃষ্টি যেখান থেকে শিল্পের আধুনিকতার সূচনা ঘটে। চিত্রের মধ্যে অনুভুতির প্রতিস্থাপন রংরেখার ভাষায় যেন বদলে গেল। ক্যানভাস হয়ে উঠলো প্রতিবাদের হাতিয়ার, দাদাবাদী শিল্পিদেরকে আমরা দেখেছি তাদের ছবি কীভাবে প্রতিবাদ করতে পারে। সমাজ জীবন, রাষ্ট্র ভাবনায় শিল্পিদের প্রগতিশীল শিল্প সৃষ্টিতে যে কতটা দৃঢ় ভূমিকা রাখতে পারে আধুনিক শিল্পকলায় তা খুঁজে পাওয়া যায়। আধুনিক চিত্রকলায় অনুভুতি আছে। বিশ্বাসের চেয়ে এখানে বিজ্ঞান প্রযুক্তির অবস্থান অনেক দৃঢ়। 

আধুনিক শিল্পের ধরণঃ বিস্তৃত উদ্ভাবন (Expansive Innovation) শিল্পির মান (Artist Value) প্রতীকবাদ (Symbolism) পরিবেশের প্রতিক্রিয়া  (Reaction to the Environment) আইকনোগ্রাফি (Iconography) আধুনিক চিত্রশিল্পের চরিত্রঃ ১। বিষয়ের নিরিক্ষণ করা। ২। চিন্তার গতিকে নির্ণয় করা। ৩। অভিব্যক্তিপূর্ণ আকার নির্ধারণ করা। ৪। নতুন ধারার অন্বেষণ। ৫। সময় ও স্থানের সংযোগ স্থাপন। ৬। আন্দোলনের ধারা বা বক্তব্য নির্মাণ করা।  ৭। প্রথাগত চর্চার বাহিরে ভিন্ন ভিন্ন কৌশল আবিষ্কার ও চর্চা করা।
যুগ যুগ ধরে চলমান শিল্পকলা, স্থাপত্য, সাহিত্য দর্শন, ধর্মীয় বিশ^াস এবং এমনকি মানুষের দৈনন্দিন কর্মকান্ড পর্যন্ত শিল্পায়নের ধাক্কায় এগিয়ে যাওয়া নয়া অর্থনৈতিক, সামাজিক এবং রাজনৈতিক পরিবেশের সঙ্গে মানানসই নয়। এগুলোকে বদলে ফেলতে হবে। আধুনিকতার ধারনাটি প্রকৃতপক্ষে শিল্প-সাহিত্যের জগৎকেই নাড়া দিয়েছে সবচেয়ে বেশি।  এই পরিবর্তন যেহেতু ইউরোপেই সূচিত হয়েছিল, তাই আধুনিকতার এই ধারনাটির সঙ্গে ইউরোপের যোগসূত্র অবিচ্ছেদ্য।